আগস্ট ৮, ২০২৫ তারিখে হোয়াইট হাউসে আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান একটি যুগান্তকারী শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, যা নাগোর্নো-কারাবাখ সংঘাতের অবসান ঘটাতে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সহযোগিতার নতুন দ্বার উন্মোচন করতে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত এই চুক্তির মাধ্যমে উভয় দেশ সীমান্ত নির্ধারণ, নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের পথে একধাপ এগিয়ে গেল।
এই ঐতিহাসিক চুক্তির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে জোরানজ়ুর করিডোরের (Zangezur corridor) একচেটিয়া উন্নয়ন অধিকার প্রদান করা হয়েছে, যা আগামী ৯৯ বছরের জন্য কার্যকর থাকবে। এই করিডোরটি "ট্রাম্প রুট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস অ্যান্ড প্রসপারিটি" (TRIPP) নামে পরিচিত হবে। এই চুক্তিটি কেবল দুই দেশের মধ্যেকার দীর্ঘদিনের সংঘাতের অবসানই ঘটাবে না, বরং দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে ভূ-রাজনৈতিকভাবেও এক নতুন সমীকরণ তৈরি করবে। জোরানজ়ুর করিডোরটি আজারবাইজানকে তার বিচ্ছিন্ন ছিটমহল নাখচিভানের সাথে সংযুক্ত করবে এবং তুরস্কের সাথে সরাসরি স্থলপথে যোগাযোগ স্থাপন করবে। এটি এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যেকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথ, যা "মিডল করিডোর" নামে পরিচিত, তার একটি অপরিহার্য অংশ। এই করিডোরের মাধ্যমে রেল, তেল, গ্যাস এবং ফাইবার অপটিক লাইনের নির্মাণ সম্ভব হবে, যা এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ এবং আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই চুক্তিকে "শান্তির পথে এক বিরাট পদক্ষেপ" হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুত্বের আশা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, "৩৫ বছর ধরে তারা লড়াই করেছে, এখন তারা বন্ধু এবং তারা দীর্ঘকাল ধরে বন্ধু থাকবে।" এই চুক্তিটি কেবল দুই দেশের মধ্যেকার সম্পর্ককেই স্বাভাবিক করবে না, বরং এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই অঞ্চলে কৌশলগত এবং বাণিজ্যিক প্রবেশাধিকার সুনিশ্চিত করবে, যা রাশিয়া, ইরান এবং চীনের প্রভাব কমাতে সহায়ক হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ঐতিহাসিকভাবে, জোরানজ়ুর করিডোরটি আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যেকার একটি সংবেদনশীল বিষয় ছিল। নাগোর্নো-কারাবাখ সংঘাতের পর, বিশেষ করে ২০২৩ সালে আজারবাইজান যখন এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করে, তখন এই করিডোরের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায়। এই চুক্তিটি সেই দীর্ঘদিনের উত্তেজনা প্রশমিত করে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই চুক্তির ফলে আর্মেনিয়া তার বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে উঠতে পারবে এবং তুরস্কের সাথেও কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করতে পারবে, যা দেশটির অর্থনীতি ও ভূ-রাজনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তবে, এই চুক্তির বাস্তবায়ন এবং এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নিয়ে কিছু প্রশ্নও রয়েছে। কিছু বিশ্লেষক মনে করছেন যে, জোরানজ়ুর করিডোরের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ইরানের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে, কারণ এটি ইরানের সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব বাড়াবে। এছাড়াও, আর্মেনিয়ার কিছু গোষ্ঠী এই চুক্তির সমালোচনা করেছে, কারণ এটি নাগোর্নো-কারাবাখ থেকে বাস্তুচ্যুত আর্মেনীয়দের তাদের মাতৃভূমিতে ফেরার অধিকার এবং যুদ্ধবন্দীদের অবস্থা নিয়ে আলোচনার বিষয়টিকে স্থগিত রেখেছে। তা সত্ত্বেও, এই চুক্তিটি দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।