দক্ষিণের ছোট রাজকুমারী (Little Princess of the South) নামে পরিচিত ইলহিউস, ব্রাজিলের বাহিয়া রাজ্যের দক্ষিণে অবস্থিত এক মনোমুগ্ধকর শহর। প্রায় ১৮০,০০০ জনসংখ্যা সহ ইলহিউস বাহিয়ার বৃহত্তম কোকো উৎপাদনকারী অঞ্চল, যেখানে ২০২৪ সালে প্রায় নয় হাজার টন কোকো উৎপাদিত হয়েছে। কোকোর সঙ্গে ইলহিউসের ইতিহাস অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রোথিত, যখন ফরাসি উপনিবেশ স্থাপনকারী লুইজ ফ্রেডেরিকো ওয়ার্নো ১৭৪৬ সালে পারা থেকে কোকো বীজ বাহিয়াতে নিয়ে আসেন। উনিশ শতকে কোকো চাষাবাদ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং এই অঞ্চলে প্রচুর সম্পদ নিয়ে আসে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, কোকো বাহিয়ার প্রধান রপ্তানি পণ্যে পরিণত হয়, যা ইলহিউসকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান কোকো উৎপাদনকারী শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। সেই সময়ে, ইলহিউসের বন্দর দিয়ে কোকো রপ্তানি শহরটিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত করেছিল এবং এর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করেছিল।
তবে, ১৯৮৯ সালে "উইচ'স ব্রুম" (Witch's Broom) নামক এক ছত্রাকজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব কোকো উৎপাদনে এক ভয়াবহ আঘাত হানে। Moniliophthora perniciosa নামক এই ছত্রাক গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত করে, হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে এবং ফলন মারাত্মকভাবে কমিয়ে দেয়। এই রোগ গাছের আক্রান্ত অংশকে শুকিয়ে দেয় এবং ডালপালাগুলিকে ঝাড়ুর মতো করে তোলে, যা সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। একসময় ব্রাজিলের অন্যতম প্রধান কোকো উৎপাদনকারী হওয়া সত্ত্বেও, এই রোগের কারণে দেশের উৎপাদন মধ্য-১৯৮০-এর দশকের প্রায় ৪০০,০০০ টন থেকে ২০০০ সালের মধ্যে প্রায় ১০০,০০০ টনে নেমে আসে। এর ফলে অনেক কোকো খামার বন্ধ হয়ে যায়, কৃষক ও শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে পড়ে এবং এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব পড়ে। এই সংকট এতটাই গুরুতর ছিল যে, ব্রাজিলকে একসময় নিম্নমানের কোকো বীজ আমদানি করতে হয়েছিল। এই প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, ইলহিউস শহরটি পর্যটন, সংস্কৃতি এবং ঐতিহাসিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের উপর জোর দিয়ে নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তুলেছে। ২০২৫ সালে, ইলহিউস "চকোলেট ফেস্টিভ্যাল বাহিয়া"-এর ১৬তম সংস্কৃতির আয়োজন করে, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। এই উৎসবে ১৫০ জনেরও বেশি প্রদর্শক এবং ১৫ জন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শেফ অংশ নেন, যা কোকো শিল্পের জন্য ইলহিউসের ভূমিকাকে বিশ্ব মঞ্চে আরও দৃঢ় করে। বাহিয়ার কোকো রপ্তানি ২০২৪ সালে রেকর্ড বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে কোকোর ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং প্রধান উৎপাদক দেশগুলির সরবরাহ হ্রাসের প্রতিফলন। এই রপ্তানি মূল্য ৪৩৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং রপ্তানি পরিমাণ ৪৬,০০০ টন ছাড়িয়ে গেছে। শহরটি তার ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক ঐতিহ্যকেও সযত্নে রক্ষা করে চলেছে। বার ভেসুভিও, সাও সেবাস্তিয়াও ক্যাথেড্রাল এবং বাতাক্লান-এর মতো স্থানগুলি এর সমৃদ্ধ অতীত এবং বিখ্যাত লেখক জর্জ আমাদোর (Jorge Amado) প্রভাবের সাক্ষ্য বহন করে। আমাদোর উপন্যাসগুলিতে ইলহিউসের জীবনযাত্রা, কোকো শ্রমিকদের সংগ্রাম এবং শহরের প্রাণবন্ত পরিবেশ জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তাঁর সাহিত্যকর্মগুলি এই শহরকে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে এবং পর্যটকদের ইলহিউসের ঐতিহাসিক স্থানগুলি পরিদর্শনে অনুপ্রাণিত করে। বর্তমানে, ইলহিউস কোকো উৎপাদন এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে তার ঐতিহ্য ও আধুনিকতার এক চমৎকার মেলবন্ধন ঘটিয়েছে। মোয়েসেস শ্মিটের মতো উদ্যোক্তারা বাহিয়াতে বিশাল, অত্যাধুনিক কোকো খামার তৈরি করছেন, যা উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক হচ্ছে এবং বিশ্ব বাজারে ব্রাজিলের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করছে। এই শহরটি কেবল কোকোর জন্যই নয়, বরং প্রতিকূলতাকে জয় করে ঘুরে দাঁড়ানোর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবেও পরিচিত। ইলহিউস তার অতীতকে সম্মান জানিয়ে এবং ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে, কোকোর মনোমুগ্ধকর জগৎকে কেন্দ্র করে এক নতুন অধ্যায় রচনা করছে।